131
খাগড়াছড়ি প্রতিদিন ডেস্ক
শহরের যান্ত্রিক ব্যস্ততায় হাঁপিয়ে ওঠা পাহাড় প্রেমীরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে ছুটে যান পাহাড় আর ঝরণার টানে। এমনই একটি জলপ্রপাত হামহাম, যা পাহাড় প্রেমীদের অন্যতম একটি তীর্থস্থান। অত্যন্ত দূর্গম আর গভীর জঙ্গলে অবস্থিত এই জলপ্রপাত পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রতি পদে পদে যেমন রয়েছে বিপদের ভয়, তেমনি রয়েছে রোমাঞ্চের হাতছানি। সেই রোমাঞ্চের টানেই পাহাড় ও প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের আকর্যণীয় স্থান হামহাম জলপ্রপাত।
পাহাড়ের শরীর বেয়ে টলমলে স্বচ্ছ পানির ধারা গড়িয়ে পড়ছে ১৫০ থেকে ১৬০ ফুট উপর থেকে। নির্জন পাহাড়ের ওপর থেকে আছড়ে পড়া স্রোতধারা শাঁ, শাঁ শব্দ বয়ে যাচ্ছে সমতলে। চোখ জুড়ানো দৃশ্যের পর্যটন কেন্দ্রটি হচ্ছে হামহাম জলপ্রপাত। এর অবস্থান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায়।
পর্যটকদের কাছে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার হাম হাম জলপ্রপাত হয়ে উঠেছে আরেকটি দর্শনীয় স্থান। গহীন অরণ্যে অবস্থিত হওয়া এই জলপ্রপাতটি ২০১০ সালের শেষাংশে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মার সাথে দুর্গম জঙ্গলে ঘোরা একদল পর্যটক আবিষ্কার করেন। যদিও ২০১১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে ৫০ সদস্যের একটি দল সরেজমিনে হাম হাম জলপ্রপাতটি পরিদর্শন করেন কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবরণ কিংবা পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এর পর থেকেই এটি বিখ্যাত হয়ে উঠে।
কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিঃ মিঃ পূর্ব-দক্ষিণে ইসলামপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রাজাকান্দি রেঞ্জের ৭ হাজার ৯৭০ একর আয়তনের কুরমা বনবিট এলাকার পশ্চিম দিকে চম্পারায় চা-বাগান। এই কুরমা বনবিটের প্রায় ৮ কিঃমিঃ অভ্যন্তরে দৃষ্টি নন্দন এ হাম-হাম জলপ্রপাতটি অবস্থিত। যা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় সীমান্তের নিকটবর্তী। এখানে বর্তমানে সরাসরি পৌঁছানোর কোন সড়ক বা ব্যবস্থা নেই। কমলগঞ্জ উপজেলা চৌমুহনা চত্বর থেকে কুরমা চেকপোস্ট পর্যন্ত ২৫ কিঃমিঃ পাকা রাস্তায় স্থানীয় বাস/জিপ/মাইক্রোবাসে করে যেতে পারলেও বাকি পথ পাহাড়ি এলাকা, পায়ে হেঁটে যেতে হয়। পায়ে হেঁটে এ রাস্তায় যেতে যেতে চোখ পড়বে চা-বাগানের অপূর্ব দৃশ্য। তবে মোটরসাইকেল বা সিএনজিতে করে গেলে আরও ৪/৫ কিঃমিঃ ভেতরে সীমান্ত ঘেঁষে ত্রিপুরা আদিবাসীদের পল্লী ও কুরমা বন বিটের অরণ্য ঘেরা দূর্গম পাহাড়ি এলাকা তৈলংবাড়ী পর্যন্ত যাওয়া যায়। সেখান থেকে মূল জলপ্রপাত ৮ কিঃমিঃ দূরে।
হাম হাম জলপ্রপাতে পর্যটকদের গহীন অরণ্য প্রবেশ করে জলপ্রপাত দেখতে হলে তৈলংবাড়ি বা কলাবন বস্তীর আদিবাসীদের সাহায্য নিতে হবে। পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথে ট্রেকিং করা খুবই কষ্টের। পিচ্ছিল রাস্তার সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে হয়। ট্রেকিং কালে সবাইকে ভারসাম্য রক্ষার্থে বাঁশের লাটি হাতে করে নিতে হয়। জারুল, চিকরাশি আর কদমের সারিবদ্ধ ডালে পাখি আর প্রজাপতির মেলা কাউকে নিয়ে যাবে সভ্যতা থেকে বহু দূর। চলার পথে ডুমুরের গাছ আর বেত বাগানে দেখা মিলবে অগুণতি চশমা বানরের। এ জলপ্রপাতটিতে যেতে পেরোতে হয় দুর্গম পাহাড়ি সরু পথ। পাহাড়ি ঝিরি ধরে হাঁটতে হয় বহু দূর। ঝিরিপথে পড়বে কখনও হাঁটু কিংবা কোমর পানি। জলপ্রপাতের অর্ধ-কিঃমিঃ দূর থেকেই শুনা যায় ঝর্ণার জলধ্বনী। শুষ্ক মৌসুমে ঝর্ণার পানি কম থাকলেও বর্ষা মৌসুমে পানি বেড়ে যায়। স্থানীয় উপজাতিদের ভাষা অনুসারে হাম হাম কথাটির অর্থ হচ্ছে প্রবল বেগে জোরে পানি পড়ার শব্দ। এ থেকে এর নাম হাম-হাম হয়েছে। হাম-হাম যাবার পথে মাকাম নামের বেশ বড় একটা পাহাড়ও পেরোতে হয়।
পায়ে হেঁটে জলপ্রপাতটিতে পৌঁছাতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় লাগে। ধরণা করা হয়ে থাকে বাংলাদেশে অবস্থিত অন্যান্য জলপ্রপাতের তুলনায় এটি প্রশস্ততম। প্রায় ৩০ ফুট প্রশস্ততা বিশিষ্ট এবং ১৩৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এ জলপ্রপাতটি। দিন দিন রোমাঞ্চকর অভিযাত্রীদের এক তীর্থভূমি হয়ে উঠেছে। ক্রমাগত পর্যটক সংখ্যা বাড়ছেই। ইতিমধ্যে সরকারি উদ্যোগে অবকাঠামো এবং যোগাযোগের সুবিধা বাড়াতে বেশ কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতা এবং রোমাঞ্চকর পরিবেশ নিঃসন্দেহে একে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান রূপ নিবে।
কমলগঞ্জ সদর থেকে গিয়েছেন রোমাঞ্চকর হামহাম ঝর্ণা দেখতে কলেজ ছাত্র, নয়ন, রিজভী, নাইম, ইমন, ইমরাম, নয়ন তুহিন তারা বলেন, ‘এত সুন্দর একটা যায়গা আমাদের এলাকায় আমরা জানতাম তবে কখনো যাইনি হঠাৎ আমরা প্রান করি আজ যাবো। সবাই একত্রিত হলাম রওয়ানা দিলাম সকাল ৬টার দিকে পৌছাই কলাবন নামক স্থানে। সেখান থেকে ২ঘন্টা লাগে আমাদের হাম হাম এর মূল জায়গায়। পৌছার পর মনটা ভরে গেলো। আনন্দ করলাম, ছবি তুললাম। সবকিছু অন্যরকম লাগছে। এটা স্মৃতি হয়ে থাকবে।’
জেলা শহর থেকে ঘুরতে আসা শিক্ষক ঝুলন চক্রবর্তী জানান, রোমাঞ্চকর হামহাম ঝর্ণা অভিযান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের এই হামহাম জ্বলপ্রপাত। বৃষ্টির দিনে এই ঝর্ণা অভিযানে গিয়েছিলাম। এর ফলে পাহাড়ী আকা বাকা পথ পিচ্ছিল হয়ে ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছিলো। কিন্ত ভিতরে যখন প্রবেশ করলাম তখন মনটা ভরে গেলো। যে কষ্ট পেয়েছিলাম যাওয়ার পথে সেই কষ্ট আর রইলো না।
এ বিষয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিফাত উদ্দিন বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণরূপে অ্যাডভেঞ্চার প্রকৃতির পর্যটন কেন্দ্র। আমাদের চিন্তা ভাবনা আছে কাজ করার। আপাতত এখানে উন্নয়নমূলক কোনো কাজ হচ্ছে না। তবে বনের ভেতর যাতায়াতের উন্নয়নের বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে।’
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে হামহাম যেতে হলে শ্রীমঙ্গল হয়ে কমলগঞ্জে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক। কমলাপুর বা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পারাবত, জয়ন্তিকা বা উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনে করে প্রথমে কমলগঞ্জ আসা যায়। ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যেতে সময় লাগে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। আর বাসে করে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে ফকিরাপুল অথবা সায়েদাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস, এনা ইত্যাদি এসি ও ননএসি বাস পাওয়া যায়। বাসে করে শ্রীমঙ্গল যেতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। তারপর যেকোন গাড়ি নিয়ে কমলগঞ্জ উপজেলায়, সেখান থেকে দ্রুত হাম হাম পৌছানো যায়। এখানকার রাস্তাঘাটও খুব ভালো।
একটু সতর্কতা:
মনে রাখতে হবে, অব্যবহৃত খাবার, চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের ফিল্টার, পানির বোতলসহ অন্যান্য আবর্জনা বনের যেখানে সেখানে ফেলানো যাবে না। এগুলো সাথে করে নিয়ে আসবেন এবং বাইরে কোথাও নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলবেন। জলপ্রপাতে যাওয়ার পথে বেশকিছু উঁচু-নিচু পাহাড়, বন, পিচ্ছিল এলাকা পার হতে হবে। তাই ট্রেকিং উপযোগী জুতা পরতে হবে এবং সতর্ক হয়ে পথ চলতে হবে। মারাত্মক কোন দূর্ঘটনা ঘটলে দূর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফিরে আসা অনেক কঠিন হবে।
খাগড়াছড়ি প্রতিদিন/ডিএইচ