১৯৬০-এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই লেক খনন করার সময় যে হাজার হাজার চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষ বাস্তুচ্যুত ও দেশছাড়া হয়েছিল, তাদের একটা বড় অংশকে নিয়ে ভারতের অরুনাচল প্রদেশে এখন নতুন করে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে।
ভারতের অরুনাচল প্রদেশ ও আসাম রাজ্যের দুটি অতি প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের যৌথ সম্মেলন থেকে শনিবার দাবি তোলা হয়েছে, অরুনাচলে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া যে চাকমারা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে রয়েছেন, তাদের অবিলম্বে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে হবে। এই দাবিটি মূলত অল অরুনাচল প্রদেশ স্টুডেন্টস ইউনিয়নের (আপসু)। তবে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নও (আসু) এখন তাতে সমর্থন জানাচ্ছে।
ভারতে বসবাসকারী চাকমা জনগোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, অরুনাচল প্রদেশে যে চাকমারা আছে, তারা মোটেও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নয়–বরং আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে তখনকার ভারত সরকারই এই শরণার্থীদের কৃষি ও বসতজমি দিয়ে অরুনাচলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিল। আজ এত বছর বাদে তাদের ‘অবৈধ’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টায় চাকমারা যথারীতি চরম ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
এই স্পর্শকাতর বিতর্কের ‘জেনেসিস’ বা উৎস খুঁজতে হলে অবশ্য প্রায় ছয় দশক পিছিয়ে যেতে হবে।
বর্তমান বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে হাজার হাজার চাকমা ভারতে এসেছিল মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, ১৯৬২ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কমিশন করা কাপ্তাই লেকের জন্য ভিটেছাড়া হয়ে; দ্বিতীয়ত, ১৯৭২ সালে পাহাড়ে ‘শান্তিবাহিনী’ গঠন হওয়ার পর সৃষ্ট উত্তেজনায় প্রাণে বাঁচতে।
গবেষকরা বলছেন, কাপ্তাই লেকের কারণে ৬৫৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছিল; যার মধ্যে ২২ হাজার হেক্টরই ছিল কৃষিজমি। এ সময় বাস্তুচ্যুত হয়েছিল প্রায় ১ লাখ উপজাতীয় লোকজন, যাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই ছিল চাকমা। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান শহর রাঙামাটির একটা বড় অংশ–যার মধ্যে চাকমা রাজাদের প্রাসাদও ছিল–পুরোপুরি জলের তলায় চলে গিয়েছিল। এরপরই হাজার হাজার চাকমা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
যে কারণে চাকমারা অনেকেই আজও কাপ্তাইকে ‘কান্নার লেক’ বলে বর্ণনা করে থাকে।
ভারতে আসা এই চাকমা জনগোষ্ঠীর অনেকেই আর কখনও পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে যায়নি। তাদের ধীরে ধীরে পুনর্বাসন করা হয়েছে ত্রিপুরা, মিজোরাম ও অরুনাচল রাজ্যে। এখন ত্রিপুরা বা মিজোরামে তারা সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেলেও, অরুনাচলে তারা আজও বঞ্চিত রয়ে গেছে। অরুনাচলে বসবাসকারী চাকমাদের স্বীকৃতি না দিতে সেখানকার সব রাজনৈতিক দলও এককাট্টা–এই প্রশ্নে সেখানকার কংগ্রেস ও বিজেপি পর্যন্ত একমত।
১৯৬৪ সালে আসামের গভর্নর (রাজ্যপাল) ছিলেন বিষ্ণু সহায়। চাকমারা যখন সীমান্ত পেরিয়ে দলে দলে মিজোরামে ঢুকছে, (মিজোরাম তখন আসামেরই অংশ ছিল), তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, এই চাকমাদের সঙ্গে স্থানীয় মিজোদের সংঘাত শুরু হবে অচিরেই। তাই তিনি কাপ্তাইয়ের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে আসা এই মানুষদের ‘নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি’ বা নেফার তিরাপ ডিভিশনে পাঠিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেন। কারণ, সেখানে তখন প্রচুর পরিমাণে ফাঁকা জমি পড়ে ছিল। সেই অনুযায়ী ১০ হাজারেরও বেশি চাকমাকে তখন ওই অঞ্চলের তিরাপ, লোহিত ও সুবনসিরি এলাকায় পুনর্বাসিত করা হয়। আর সেই দলে আরও হাজার দুয়েক হাজং জনগোষ্ঠীর লোকও ছিল।
সেই ‘নেফা’ই আজকের অরুনাচল প্রদেশ–পুনর্বাসিত চাকমা ও হাজংরা সেখানকার বিজন প্রান্তরে গিয়ে ফসল ফলিয়েছে, বসত গড়েছে। তিরাপের মতো কোনও কোনও জেলার ভোল পর্যন্ত বদলে দিয়েছে তারা। আর এটাকে কেন্দ্র করেই তাদের ভূমিপুত্র অরুনাচলীদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের।
শনিবার (২৯ জুলাই) অরুনাচল প্রদেশের রাজধানী ইটানগরে ‘আপসু’ ও ‘আসু’র যৌথ কনক্লেভ ছিল চাকমাদের বিরুদ্ধে সেই সংঘবদ্ধ অভিযানে সবশেষ সংযোজন। আপসু নেতারা সেখানে বলেন, ‘অবৈধ’ চাকমা ও হাজংদের কারণে অরুনাচলের ভূমিপুত্ররা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং তাদের রাজ্যছাড়া করার জন্য সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের অরুনাচল থেকে তাড়ানোর জন্য অচিরেই তীব্র আন্দোলন শুরু করারও হুঁশিয়ারি দেন তারা।
‘আসু’র উপদেষ্টা ও অন্যতম শীর্ষ নেতা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্যও সেখানে ঘোষণা করেন, অবৈধ চাকমাদের অরুনাচলের মাটি থেকে ‘ডিপোর্ট’ করতে আপসু যে দাবি জানাচ্ছে, তাতে তারাও পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছেন।
‘চাকমা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুহাস চাকমা অবশ্য পাল্টা দাবি করছেন, ‘চাকমারা কখনোই অরুনাচলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নয়। ভারত সরকার ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে ১৪ হাজার চাকমা ও হাজংকে সেখানে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসিত করেছিল। প্রত্যেক পরিবারকে কিছু পরিমাণ কৃষিজমিও দেওয়া হয়েছিল।’
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর ওই সীমান্ত অঞ্চলে ভারতের নিরাপত্তা বাড়ানোর স্বার্থেই পরিকল্পনা মাফিক চাকমা-হাজংদের ওই পুনর্বাসন করা হয়েছিল বলেও তিনি জানান।
সুহাস চাকমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘অরুনাচলের সঙ্গে চীন ও মিয়ানমারের সীমান্ত থাকলেও, বাংলাদেশের সঙ্গে কিন্তু কোনও সীমান্ত নেই। ফলে বাংলাদেশ থেকে চাকমা-হাজংরা সেখানে অবৈধভাবে ঢুকে পড়ে বসবাস করছে, এটা বলাটা “জেনোফোবিয়া” ছাড়া কিছুই নয়।’
এই জেনোফোবিয়ার কারণেই আজ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল জ্বলছে, অথচ মনিপুরের ঘটনা থেকেও কেউ যে শিক্ষা নিতে রাজি নয়, চাকমাদের অরুনাচল থেকে তাড়ানোর দাবিতে তা আরও একবার স্পষ্ট হলো বলে মনে করছেন সুহাস চাকমা।
খাগড়াছড়ি প্রতিদিন/দিআরা
